বরিশাল প্রতিবেদক।। বরিশালের বাবুগঞ্জে শতাধিক অবৈধ ইট ভাটার আগুনে পুড়ছে কৃষকের কপাল। কয়লার পরিবর্তে কাঠ পুড়িয়েই চলছে অবৈধ সব ইটভাটা, হুমকির মুখে পরিবেশ।
পরিবেশ রক্ষায় সচেতন মানুষের অন্দোলনের মুখেও বরিশাল বিভাগে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে অবৈধ ইটভাটা। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসেব মতে, এ বিভাগে বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে মোট ৫০০ ইটভাটা রয়েছে।
এর মধ্যে ১৫০টিই অবৈধ। ফলে একদিকে প্রতি বছর সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। অন্যদিকে ক্রমেই হুমকির মুখে পড়ছে পরিবেশ। প্রতিনিয়তই বাড়ছে এসব এলাকার মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব ইটভাটায় ইট তৈরিতে প্রতি বছর কমপক্ষে এক কোটি টন মাটি ব্যবহার হয়। যার বেশিরভাগ আসে কৃষিজমি থেকে।
এছাড়া ইট পোড়াতে কয়লার পরিবর্তে কাঠ। আর এই কাঠ পোড়া কালো ধোঁয়া সব সময়ই আচ্ছন্ন থাকে গোটা এলাকা। বাতাসে ধুলোবালি উড়তে থাকায় মানুষের মধ্যে বাড়ছে শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগ বালাই।
স্থানীয়রা বলছেন, অনুমোদনযুক্ত ও অনুমোদন বিহীন দু’রকমের ইটভাটার কালো ধোঁয়া পরিবেশের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এছাড়া অবৈধ ইটভাটাগুলো বছরের পর বছর চলছে কীসের ভিত্তিতে?
ঝালকাঠির নাসির উদ্দিন নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রশাসন না চাইলে রাস্তার পাশে পানও বিক্রি করা যায় না। কিন্তু অবৈধ ইটভাটাগুলো বছরের পর এভাবে চলছে, কিন্তু তাদের কিছু বলছে না। প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করেই যেখানে দুর্নীতি চলে, সেখানে দুর্নীতি কিংবা পরিবেশ বাঁচাবে কে?
অভিযোগ রয়েছে জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও প্রশাসন ম্যানেজ করে চলছে এসব অবৈধ ইটভাটা। ফলে উল্লেখযোগ্য ভাবে কমছে বন ও কৃষি জমি। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে বরিশাল বিভাগের ৫০০টি ইটভাটা থাকলেও মালিকরা জানিয়েছেন, এই সংখ্যা আনুমানিক প্রায় ১ হাজার। এসব ইটভাটার কাঁচামাল হিসেবে মাটি যোগাড় করা হচ্ছে কৃষিজমি থেকে। এ কারণে কৃষিজমিগুলো বছর বছর উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যে জানা গেছে, বিভাগের ৬ জেলার ৪২ উপজেলায় বৈধ ও অবৈধ মোট ইটভাটার সংখ্যা ৫০০টি। এর মধ্যে বরিশাল জেলায় রয়েছে ২০০টি। এর অর্ধেক অর্থাৎ ১০০ অবৈধ।
এর মধ্যে গত এক সপ্তাহে ১০টি অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
এছাড়া বৈধ ও অবৈধ ৯০টি ইটভাটা নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ভোলা জেলায়। এছাড়া বৈধ ও অবৈধ বরগুনায় ৬০, ঝালকাঠিতে ৫১, পিরোজপুরে ৩৭টি এবং পটুয়াখালীতে আনুমানিক ৬২টির মতো ইটভাটা রয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদফতরের উপপরিচালক এইচ, এম রাসেদ।
তিনি বলেন, এসব ইটভাটার ভিতরে অনেকটার কার্যক্রম আগে থেকেই বন্ধ। যেগুলো চলমান রয়েছে তার ভিতরে যার অনুমতি নেই সেই সব ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
অবৈধভাবে ইটভাটা পরিচালনা করার জন্য বিভাগের বিভিন্ন উপজেলায় অভিযান চালিয়ে গত এক মাসে ১০টি ইটভাটা ভেঙে ফেলাসহ ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।
কৃষি জমি থেকে মাটি কেটে ইট ভাটায় বিক্রি করা হচ্ছে। অন্যদিকে কয়লা পোড়াতে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের কাঠ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক অবৈধ ইটভাটার মালিক জানান, বৈধভাবে ইট প্রস্তুত করতে চাই। কিন্তু বিভিন্ন ধরণের অনুমোদন নিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হতে হয়। কাগজ ঠিক করে এ ব্যবসা করতে গেলে কখনো লাভবান হওয়া সম্ভব না। তাই অনৈতিক পথে এই ব্যবসা করতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভাটা মালিকরা বলেন, পুলিশ প্রশাসনসহ বিভিন্ন সেক্টরে অর্থ দিয়ে তাদের ম্যানেজ করা হয়। প্রতিপক্ষের লোকজন ষড়যন্ত্র করে মাঝে মধ্যে ভ্রম্যমাণ আদালত পরিচালনায় উৎসাহিত করেন। ফলে আমাদের আর্থিকভাবে অনেক ক্ষতি হয়।
ভোলার লালমোহর উপজেলার মাহী ব্রিকস্রে মালিক মাইন উদ্দিন মিয়া তালুকদার বলেন, শীত মৌসুমের প্রথম দিকে গাছ পুড়িয়েই ইট তৈরি করা হচ্ছে। কয়েকদিন পরে আর গাছ পুড়বো না। কয়লাতেই ইট তৈরি করবো। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র আছে কি না, লাইসেন্স পেয়েছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন।
বাবুগঞ্জ উপজেলার বৈধ এমটিসি ইটভাটার মালিক শফিকুল করিম বলেন, অবৈধ ইট ভাটার দৌরাত্ম্যে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। আমাদের যা উৎপাদন খরচ, তার চেয়ে কম রেটে অবৈধ ভাটাগুলো ইট বিক্রি করে। ফলে আমরা আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হই।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বরিশাল জেলা কমিটির সভাপতি হিরন কুমার মিঠু বলেন, ক্যাব দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু কিছুতেই এরা থামছে না। যারা এই অবৈধ ইটভাটা পরিচালনা করছে তারা অনেকই ক্ষমতাসীন দলের নেতা। কেউবা স্থানয়ীভাবে প্রভাবশীল হওয়ায় পরিবেশ অধিদপ্তরে অভিযোগ দিলেও কেউ কর্ণপাত করেন না। আমরা প্রশাসনের কাছে গেলেও তারা শুধু তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেয়। কিন্তু কোনো কাজ হয় না।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ২০১০ ও ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৩-এ বলা হয়েছে, বসতবাড়ি, পাহাড়, বন ও জলাভূমির এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। পাশাপাশি কৃষিজমিতেও ইটভাটা করা নিষেধ করা হয়েছে এই আইনে। অথচ এসব অধিকাংশ ইটভাটাই চলছে কৃষিজমিতে।
প্রকাশ্য কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরি করার এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বরিশাল বিভাগীয় বন সংরক্ষক হারুন অর রশিদ খান বলেন, আমরা ইতোমধ্যে এমন অভিযোগ বিভিন্ন পেয়েছি। যেসব ইটভাটায় এ ধরণের কার্যক্রম চলছে, তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এরপর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
ইটভাটার মালিকরা অবৈধভাবে তাদের ম্যানেজ করেছেন এমন বিষয়টি তিনি অস্বীকার করে বলেন, তারা মিথ্যা ছড়াচ্ছে। কথাগুলো সঠিক নয়।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক ইকবাল হোসেন বলেন, আমার জনবল সংকটের কারণে কোন অভিযান চালাতে গেলে জেলা প্রশাসনের মুখের দিকে চেয়ে থাকতে হয়। তারপরেও অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি বেশ কিছু ইটভাটায় ভ্রম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে অর্থদণ্ডসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।