অনলাইন ডেস্ক । উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত নিত্যপণ্য পৌঁছতে কয়েক দফা হাতবদলের দায় এখন ক্রেতার ঘাড়ে। প্রান্তিক চাষিদের কাছ থেকে ৩০-৪০ টাকা কেজি দরে কেনা কাঁচামরিচ ঢাকায় আসতে না আসতেই কেজি দাঁড়ায় ১০০ টাকা। পেঁয়াজ থেকে শুরু করে আলু ও সবজিসহ সব পণ্যের দামই একইভাবে বেড়ে যায়।
এভাবে হাতবদলের মধ্য দিয়ে বাজারে ফায়দা লুটছে অসাধু চক্র। আর নাভিশ্বাস উঠছে সাধারণ ক্রেতার। সবমিলিয়ে দ্রব্যমূল্যের জাঁতাকলে এখন পিষ্ট নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জীবন।
যদিও উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পণ্য পৌঁছানোর ব্যবস্থা সহজ করতে কাজ শুরু করেছেন নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু। তিনি পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সাপ্লাই চেইন নিরবচ্ছিন্ন রাখার বিষয়ে জোর দিয়েছেন।
বাজর ঘুরে দেখা গেছে, ৫০ টাকার নিচে বাজারে ভালো মানের কোনো সবজি পাওয়া যায় না। কাঁচাবাজারে সকল পণ্যের দাম এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দেড় মাস আগেও আলুর দাম ছিল ২০-২৫ টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০-৫০ টাকায়।
গত জুলাই মাসে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আলুর উৎপাদন ও দাম নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠায়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ টাকার আলু ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে। সাধারণত কৃষকের হাতে আলু শেষ হওয়ার পর জুন থেকে হিমাগারের আলু বাজারে আসতে থাকে।
বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছরই দেশে প্রায় কোটি টন আলু মজুত থাকে। আলুর মৌসুমে যখন আলু সংরক্ষণ করা হয়, তখন প্রতি কেজি আলুর দাম ধরা হয় সর্বোচ্চ ১৪ টাকা। হিমাগার ভাড়া বাবদ, বাছাই খরচ, ওয়েট লস, মূলধনের সুদ এবং অন্যান্য খরচ ধরে কোল্ড স্টোরেজ পর্যায়ে প্রতি কেজি আলুর দাম সর্বোচ্চ ২১ টাকা পড়ে। কোল্ড স্টোরেজ পর্যায়ে বিক্রয় মূল্যের ওপর সাধারণত ২ থেকে ৫ শতাংশ, পাইকারি পর্যায়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ যোগ করে ভোক্তার কাছে আলু বিক্রি করার কথা। সেক্ষেত্রে কোল্ড স্টোরেজ পর্যায়ে এক কেজি আলুর মূল্য ২৩ টাকা হলে আলু সংরক্ষণকারীর ২ টাকা মুনাফা হয়।
এদিকে এক মাস আগেও টমেটোর দাম ছিল ৫০ থেকে ৬০ টাকা, বেগুন ৬০-৮০ টাকা। বর্তমানে প্রতিকেজি টমেটোর দাম ৬০-৮০ টাকা, বেগুন ১০০-১২০ টাকা। ফুলকপি-বাঁধাকপি প্রতি পিছ ৬০-৭০ টাকা, শসার দাম কেজি দরে ১০০ টাকা, গাজর ১০০ টাকা, একটি সাধের লাউয়ের দামও এখন ৮০-১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মিষ্টি কুমড়া এখন বিক্রি হচ্ছে কেজি দরে, সেই হিসেবে ছোট আকারের ২ কেজি ওজনের একটি মিষ্টি কুমড়ার দাম ৭০-৮০ টাকা, পেঁপে ৬০ টাকা ও ব্রকলি ৫০ টাকা।
রমজান না হলেও বেগুনের দাম ইতোমধ্যে সেঞ্চুরিতে পৌঁছে গেছে। বরবটি প্রতি কেজি ৮০-১০০ টাকা। গাজর বিক্রি হচ্ছে কেজি দরে ৭০-৯০ টাকায়।
শিমের কেজি ৬০-৮০ টাকা, মুলা ৪০ টাকা, লাল মুলা ৫০ টাকা, পেঁপে ৪০ টাকা, পটল ৭০ টাকা, শালগম ৫০ টাকা, দেশি গাজর ৫০ টাকা, ঢেঁড়স ১০০ টাকা, কচুর লতি ৮০ টাকা, বরবটি ১০০ টাকা, মটরশুঁটি ১৪০ টাকা, কাঁচকলার হালি বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকায়, ধনেপাতা ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন সাইজের লেবু বিক্রি হচ্ছে ২০-৪০ টাকা হালি দরে। মাত্র ২-৩ মাসের ব্যবধানে এসব সবজির দাম দুই থেকে পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
যাত্রাবাড়ীর কাঁচাবাজারে কথা হয় চাকরিজীবী ইমন মিয়ার সঙ্গে। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, কাঁচাবাজারের সকল পণ্যের দামই লাগামছাড়া। বাজার খরচ এত হলে ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ জোগাবো কোথা থেকে। যে টাকা বেতন পাই তা বাজারেই শেষ। বাসা ভাড়াতো আছেই। সব জিনিসেরই দাম বেড়ে চলছে। এ বিষয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর বেশিরভাগ বাজারেই বিক্রেতাদের ধাপে ধাপে দিতে হয় চাঁদার টাকা। প্রভাবশালী মহলের কাছে তারাও এখন জিম্মি। চাঁদাবাজির টাকা বেশি দিতে হয় বলেই অনেক ব্যবসায়ী তাদের লোকসান পুষিয়ে নিতে দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক পণ্যের।
এ বিষয়ে কারওয়ান বাজারের এক কাঁচামাল ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তারা কাঁচামাল সরবরাহ করে থাকেন। পণ্যবাহী পরিবহনগুলো থেকে সড়কের একাধিক পয়েন্টে প্রশাসন থেকে শুরু করে বেশকিছু চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটকে তাদের চাঁদা দিতে হয়। তাই পণ্যের দর শিথিলতার মধ্যে রাখতে চাইলেও তারা তা করতে পারছেন না। এছাড়াও কিছু অসাধু পাইকারি ব্যবসায়ী বিভিন্ন পণ্য মজুত রেখে বাজারদর বাড়িয়েই চলছে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কার্যক্রম শাখার সহকারী পরিচালক তাহমিনা বেগম ঢাকা টাইমসকে বলেন, নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। দাম নিয়ন্ত্রণে অভিযানও অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে রাজধানীর খুচরা বাজারে সবচেয়ে কম দামের মোটা স্বর্ণা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা কেজিতে। খুচরায় প্রতিকেজি আটাশ চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৬ টাকা, পাইজাম চাল ৫৮ থেকে ৬০ টাকা, মিনিকেট চাল ৭৫ টাকা, নাজিরশাইল চাল ৭৫ টাকা কেজিদরে। পাশাপাশি সকল চালের মূল্যই বস্তাপ্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়েছে।
বাজারে প্রতিকেজি রুই (আকারভেদে) বিক্রি হচ্ছে ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা, পাবদা মাছ প্রতি কেজি ৪০০ টাকা, তেলাপিয়া মাছ প্রতি কেজি ২০০, চিংড়ি প্রতি কেজি ৫৫০-৬৫০, গলদা প্রতি কেজি ৭০০-৮০০ টাকা, শিং মাছ আকার ভেদে প্রতি কেজি ৪৮০-৫৫০, কাতল প্রতি কেজি ৩৫০, শোল মাছ ছোট সাইজের প্রতি কেজি ৫০০-৬০০, টেংরা মাছ ছোট প্রতি কেজি ৫০০-৬০০, পাঙাশ প্রতি কেজি ২২০, বোয়াল প্রতি কেজি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা এবং রূপচাঁদা বিক্রি হচ্ছে আকার ভেদে কেজি প্রতি ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায়।
এদিকে রমজানের আগেই বাড়ছে মাংসের দাম। গরুর মাংসের দাম কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৭৮০ টাকা। এছাড়াও প্রতিকেজি বয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা, সোনালি মুরগি ৩২০ এবং লেয়ার মুরগি ৩০০ টাকা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কারসাজিকারীদের জরিমানা বা শাস্তি দৃষ্টান্তমূলক হলেই শুধু তার সুফল পাওয়া যেতে পারে।
ব্যবসায়ীদের দাবি, পণ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন উপকরণের দাম বেড়েছে। তাই নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন অসাধু ব্যবসায়ীরা বেশি পরিমাণ পণ্য কিনে মজুত রাখছে। এজন্য সাময়িকভাবে বাজারে কিছু পণ্যের সংকট দেখা দিয়েছিল। মোহাম্মদপুর টাউন হল কাঁচাবাজার বণিক সমিতির সভাপতি মো. লুৎফর রহমান (বাবুল) ঢাকা টাইমসকে বলেন, খুচরা বিক্রেতা হিসেবে প্রতিদিনই ক্রেতাদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ করতে হয়। কিন্তু কৃষক থেকে আমাদের কাছে পৌঁছায় আমদানিকারকরা। আমদানিকারকরা যদি আমাদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করে তাহলে ক্রেতাদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করা ছাড়া উপায় থাকে না। খুচরা ব্যবসায়ীদের কেউই খুব সম্পদশালী নন। পণ্য উৎপাদনের পর কৃষক পর্যায় থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত যারা আমদানির সঙ্গে জড়িত তারা অনেক টাকার মালিক। এই সিন্ডিকেট ভাঙ্গা বেশ কঠিন।
পণ্যের তেমন সংকট না থাকলেও পাইকাররা তাদের মজুতকৃত পণ্যে দাম বৃদ্ধি করায় বাজারের সকল পণ্যের দাম এখন ঊর্ধ্বগতি। তাই আগের দামে বিক্রি করলে লোকসান গুনতে হবে তাদের। এদিকে নিত্যপণ্য উৎপাদনকারী চাষিরা পাচ্ছেন না ন্যায্যমূল্য। সিন্ডিকেটের কাছেই এখন জিম্মি সবাই।