শীত অনেকের জন্য পছন্দের ঋতু হলেও নানা সমস্যার সৃষ্টি হয় এই ঋতুতে। শীতে শরীরের অন্যতম সমস্যার একটি হলো মাথায় খুশকি। আবহাওয়ার পরিবর্তন, দূষণ, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার কারণে, প্রায় সারা বছরই খুশকির সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। চুল পড়ে যাওয়া, রুক্ষ হওয়া, মাথার ত্বকে নানা রকমের সংক্রমণে জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দায়ি খুশকি।
খুশকির সবচেয়ে সাধারণ কারণ বলা যেতে পারে সেবোরেইক ডারমাটাইটিস বা ত্বকের তৈলাক্ত ও চুলকানিপ্রবণ অবস্থাকে।
এক ধরনের ছত্রাক আছে যার নাম মেলাসেজিয়া। সব প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মাথার খুলিতেই এই মেলাসেজিয়া ছত্রাক থাকে। মেলাসেজিয়া নতুন ত্বক কোষ জন্মাতে সহায়তা করে। কিন্তু ত্বকে ময়লা জমে তেল চিটচিটে অবস্থার মধ্যে এই ছত্রাক বিপদে ফেলতে পারে। এ অবস্থায় জন্মানো অতিরিক্ত ত্বক কোষগুলো মরে যায় এবং ঝরে পড়ে। মাথা থেকে ঝরে পড়া সাদা-হলদে খুশকি আসলে আমাদের ত্বকের মৃত কোষ। তবে মাথা ছাড়াও বাহুমূল, ঊরুসন্ধিসহ শরীরের অন্যত্রও খুশকি হতে পারে। মহিলাদের চেয়ে পুরুষদের মধ্যে আক্রান্তর হার বেশি। পৃথিবীর প্রায় সব জায়গার লোকই খুশকিতে আক্রান্ত হয়। খুশকির ফলে স্ক্যাল্পে চুলকানি, চুল পড়া দেখা দেয়।
খুশকির সমস্যা থেকে রেহাই পেতে বাজারে নানা ধরনের শ্যাম্পু বা লোশন পাওয়া যায়। সেগুলিতে থাকা রাসায়নিক উপাদানের প্রভাবে চুলের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই খুশকির সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে শুরু থেকেই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তাই খুশকির সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে শুরু থেকেই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তবে তার আগে জেনে নিন খুশকি ঠিক কী কী কারণে হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, খুশকি হওয়ার মূল কারণ হল ফাঙ্গাল ইনফেকশন এবং চিরুনি শেয়ার করার মাধ্যমে এটি ছড়াতে পারে। এছাড়াও, চুল না ধোওয়া হলে এবং মাথার ত্বকে ঘাম জমে থাকলে, ফাংগাল ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়। ঘাম জমে এবং ধুলো-ময়লা জমে খুশকি হয়।
চুলে যদি ময়লা জমে এবং তা ঠিক করে পরিষ্কার না করা হয়, তাহলে খুশকি হওয়ার সম্ভাবনাও অনেকটাই বেড়ে যায়।
যারা গরম পানি দিয়ে গোসল করেন, তাদের ক্ষেত্রে খুশকির সমস্যা বেশি লক্ষ্য করা যায়। চুল ধোওয়ার জন্য সবসময়, সাধারণ তাপমাত্রায় পানি ব্যবহার করুন। গরম পানি মাথায় দিলে পরিস্থিতির আরও খারাপ হয়ে উঠতে পারে।
মাথার ত্বক অতিরিক্ত তৈলাক্ত অথবা শুষ্ক হলে খুশকির সমস্যা দেখা দিতে পারে। তৈলাক্ত ত্বকে ধুলোবালি বেশি জমে। ত্বকের মৃত কোষগুলোর অত্যধিক বৃদ্ধি হলে খুশকি হয়। যারা দৈনন্দিন সঠিকভাবে চুল আঁচড়ায় না, চুলে ঠিকমতো শ্যাম্পু করেন না তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা বেশি দেখা যায়।
আমাদের খাদ্যাভ্যাসও ত্বক ও চুলের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। তাই অপুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ এবং পানি কম পান করলে, খুশকির সমস্যা দেখা দিতে পারে।
শ্যাম্পু করার পর চুল ভাল করে না ধুলে বা মাথার তালুতে কন্ডিশনার লাগিয়ে ফেললে এবং ঠিকভাবে না পরিষ্কার করলে, খুশকির সমস্যা দেখা দিতে পারে।
অত্যাধিক চিন্তার ফলে তা মাথার ত্বকের ওপর প্রভাব ফেলে, যার ফলে খুশকির সমস্যা দেখা যায়। তাই খুশকি হওয়ার অন্যতম কারণও মানসিক দুশ্চিন্তা হতে পারে।
পরিবার বা বন্ধুদের কারুর মাথায় যদি খুশকি থাকে এবং তার ব্যবহৃত তোয়ালে বা চিরুনি অন্য কেউ ব্যবহার করে, তবে সেই ব্যক্তিরও খুশকি হতে পারে।
এবার জেনে নেওয়া যাক এমন বেশ কিছু কার্যকরী প্রাকৃতিক ঘরোয়া উপায় যেগুলো খুশকির সমস্যা সহজেই দূর করতে সক্ষম। সামান্য খরচে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছাড়াই খুশকির সমস্যার সমাধান করুন।
খুশকি তাড়াবে টকদই
খুশকির সমস্যা থেকে বাচঁতে টকদই অত্যন্ত কার্যকরী একটি উপাদান। খুশকি দূর করতে মাথার ত্বকে টকদই দিয়ে ভালোভাবে মালিশ করুন। এরপর মিনিট দশেক রেখে ভাল করে ধুয়ে ফেলুন। খুশকির সমস্যা পুরোপুরি দূর না হওয়া পর্যন্ত সপ্তাহে অন্তত দু’বার এই ভাবে চুলে টকদই ব্যবহার করুন।
ভালো ফল দেয় মেথি
২-৩ চামচ মেথি সারারাত জলে ভিজিয়ে রেখে সকালে ছেঁকে নিয়ে ভাল করে বেটে নিন। ছেঁকে নেওয়া জল ফেলে দেবেন না। এবার মেথি বাটা চুলের গোঁড়ায় মাথার ত্বকে ভাল করে লাগিয়ে নিয়ে ঘণ্টা খানেক রেখে দিন। এরপর শুকিয়ে গেলে চুল ভাল করে ধুয়ে ফেলুন। চুল ধোয়ার পর মেথি ভেজানো জল দিয়ে আরও একবার চুল ধুয়ে নিন। এভাবে সপ্তাহে দু’বার মেথি ব্যবহার করলে খুশকির সমস্যা দ্রুত দূর হবে।
সহজলভ্য লেবুর রস
২ চামচ পাতি লেবুর রস সামান্য জলের সঙ্গে মিশিয়ে মাথার ত্বকে ভালভাবে মালিশ করুন। মিনিট পাঁচেক চুলের গোড়ায় ভালভাবে মালিশ করার পর চুল ধুয়ে নিন। খুশকির সমস্যা পুরোপুরি দূর না হওয়া পর্যন্ত সপ্তাহে অন্তত ২ বার এই ভাবে পাতি লেবু ব্যবহার করুন।
নারিকেল তেলে খুশকি দূর
নারিকেল তেল চুলের যেকোনো সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য উপাদান। খুশকির প্রকোপ কমাতেও এটি অত্যন্ত কার্যকর। এছাড়া চুলে গোড়ার আদ্রতা বজায় রেখে খুশকি এবং ‘স্ক্যাল্প ইনফেকশন’ এর আশঙ্কাও অনেকটাই কমিয়ে দেয় নারকেল তেল। সপ্তাহে অন্তত ২-৩ বার চুলের গোড়ায় সামান্য উষ্ণ নারিকেল তেলের মালিশ করলে ফল পাবেন হাতেনাতে।
কার্যকরী পেঁয়াজের রস
২টি পেঁয়াজ ভাল করে বেটে এক মগ জলে মিশিয়ে নিন। এবার পেঁয়াজের রস মেশানো ওই জল মাথায় লাগিয়ে ভাল করে মালিশ করুন। কিছু ক্ষণ পর উষ্ণ জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এভাবে সপ্তাহে অন্তত ২-৩ বার পেঁয়াজের রস মাথার ত্বকে মাখলে খুশকির সমস্যায় দ্রুত উপকার পাবেন।
গ্রিন টি
ব্যাক্টেরিয়া-রোধী উপাদান সমৃদ্ধ এবং এটা মাথার ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়তা করে। তাই খুশকি কমাতে গ্রিন টি ব্যবহার করতে পারেন। এক কাপ গরম পানিতে দুটা টি ব্যাগ ২০ মিনিট ধরে ডুবিয়ে রাখুন। ঠাণ্ডা হয়ে আসলে তা মাথার ত্বকে ব্যবহার করে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করুন। এর পর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে তা চুল ধুয়ে নিন।
বেকিং সোডা
হালকা পানিতে মাথা ভিজিয়ে নিয়ে খানিকটা বেকিং সোডা পুরো মাথায় মেখে নিন। ভালো করে ঘষে ঘষে শ্যাম্পু না করে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এটা মাথার খুলিতে থাকা ছত্রাক দমন করে প্রথমদিকে ত্বককে অতিরিক্ত শুষ্ক করে ফেলতে পারে। কিন্তু অল্পদিনেই ত্বকে স্বাভাবিক তৈলাক্ত অবস্থা ফিরে আসবে। কিন্তু এ সময়ে আপনি খুশকি থেকে মুক্তি পাবেন।
ক্যাস্টর অয়েল
ক্যাস্টর বিনস থেকে তৈরি হয় ক্যাস্টর অয়েল। এই তেল চুলের বৃদ্ধি ঘটায়, পাশাপাশি মাথার ত্বকের চিকিৎসায়ও কাজে আসে। ক্যাস্টর অয়েল খুবই চটচটে প্রকৃতির হয়। এটি সরাসরি চুলে না লাগিয়ে, অলিভ অয়েল এবং নারকেল তেলের সাথে মিশিয়ে চুলে লাগান। চুলে ক্যাস্টর অয়েল লাগানোর জন্য, দুই চামচ ক্যাস্টর অয়েলের সঙ্গে দুই চামচ নারকেল তেল মিশিয়ে নিন। তারপর মাথার ত্বক ও চুলে ভালভাবে লাগান। তেল লাগানোর সময় চুলে হালকা করে ম্যাসাজ করুন। রাতে চুলে তেল লাগিয়ে পরের দিন অ্যান্টি-ড্যানড্রাফ শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার ক্যাস্টর অয়েল ব্যবহার করুন। হালকা হলুদ রঙের এই তেল ব্যবহারে খুশকি যেমন কমবে, তেমনই চুল হবে সফ্ট ও স্মুথ। এছাড়াও, এটি চুলের গোড়া মজবুত করে ও নতুন চুল গজাতেও সাহায্য করে।
নিমতেল
ছত্রাকজনিত সমস্যায় নিমের গুণাগুণ সর্বজনবিদিত। দু’ফোঁটা নারকেল তেলের সঙ্গে মিশিয়ে নিন দু’ফোঁটা নিমতেল। স্ক্যাল্পে মালিশ করে আধ ঘণ্টা রেখে পানি দিয়ে ধুয়ে নিন। সপ্তাহে দুই থেকে তিন বার এই ঘষামাজা চায় আপনার চুল।
অ্যালোভেরা জেল
আয়ুর্বেদের ঘৃতকুমারী এখন ‘অ্যালোভেরা’ নামেই পরিচিত বেশি। ত্বক ও চুলের অজস্র সমস্যার একটাই সমাধান- এই ওষধি। বাড়িতে একটু বড় টবে বসাতে পারেন ঘৃতকুমারী। খুব বেশি যত্নআত্তিও দরকার হয় না। বাড়িতে না থাকলেও অসুবিধে নেই। এখন অনেক বড় সংস্থার অ্যালোভেরা জেল বাজারে পাওয়া যায়। স্নানের এক ঘণ্টা আগে ঘৃতকুমারী রস বা অ্যালোভেরা জেল স্ক্যাল্পে বৃত্তাকারে মালিশ করুন। তারপর হাল্কা শ্যাম্পু দিয়ে খুব ভাল করে মাথা ধুয়ে নিন। সপ্তাহে দু’বার আপনার চুলকে দিন ঘৃতকুমারীর স্পর্শ। খুসকি দূর হবে। সেই সঙ্গে চুলের জেল্লাও বাড়বে।
রসুন
রসুনের কয়েকটি কোয়ার খোসা ছাড়িয়ে নিন। তারপর চাটুতে হাফ কাপ অলিভ অয়েলের সঙ্গে ওই রসুনের কোয়া গরম করুন। পাঁচ মিনিট হাল্কা বা মাঝারি আঁচে রাখুন মিশ্রণটিকে। এর পর সেটি স্ক্যাল্পে মালিশ করুন। শেষে জল দিয়ে খুব ভাল করে চুল ধুয়ে নিন। রসুনের গন্ধে আপত্তি থাকলে শ্যাম্পুও করে নিতে পারেন। শীতের মরসুমে সপ্তাহে দু’বার এ ভাবে যত্ন নিন চুলের।
শুষ্ক এবং তেলতেলে, দুই রকমের চুলেই খুসকির সমস্যা দেখা যায়। ঘরোয়া উপকরণগুলো ব্যবহারে খুসকির সমস্যা দূর না হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে মেডিকেটেড সামগ্রী ব্যবহার করুন।